
অ্যান্টিবায়োটিকের পরাজয়
মোঃ আবু হানিফ রুপক
এইডসের চেয়ে বড় ঘাতক ব্যাধি আর কী হতে পারে? কে সবচেয়ে বুদ্ধিমান? আমরা মানুষরা নাকি মস্তিষ্কবিহীন ব্যাকটিয়ারা? হ্যা প্রশ্নগুলো কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক এবং বেমানান শুনালেও প্রশ্নগুলোর পেছনে রয়েছে একটি চরম বাস্তব এবং আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অন্ধকার অধ্যায়। তপু রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র। ছেলেটা হঠাৎ করেই সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হল। কোনো ঔষধেই জ্বর ভালো হচ্ছে না। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ইনফেকশন দেখা দিল। ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হবার পর ডাক্তার তাকে তার পুজ (মৃত White Blood Cell) পরিক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠাল। ল্যাব রিপোর্টে জানা গেল তপুর শরীর সর্দি জ্বর প্রতিরোধকারী এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। সাধারণ কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে সে আর ভালো হবে না। হাই ডোজের অর্থাৎ Higher Generation- এন্টিবায়োটিক দিতে হবে তাকে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সে হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খেল। ডাক্তার এক সপ্তাহের ডোজ দিয়েছেন। দুই দিন ঔষধ যাওয়ার পর তপু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল। তারপর সে আবারো পড়াশোনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। পুরো ডোজ নেওয়া হল না আর। কয়েকমাস পর হঠাৎ করে একদিন সে একই সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হন। ডাক্তারের প্রেস্ক্রাইব করা সেই অ্যান্টিবায়োটিকও খেলো। কিন্তু কোনো কাজই হল না। এবং আবারো টেস্ট করে জানা গেল সে সকল অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। উক্ত ঘটনাটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক কিন্তু যে ঘটনাটা তপুর সাথে ঘটেছিল এ অবস্থাকে বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। হঠাৎ করে জ্বর কিংবা সর্দি কাশি হলে আমরা বাসার পাশের ফার্মেসি থেকে দুইটি জিম্যাক্স অ্যান্টিবায়োটিক এনে খেয়ে ফেলি। দুই দিন পর একটু সুস্থ হলেই ঔষধ খাওয়া বাদ দিয়ে দিই। এক্ষেত্রে কী ঘটে আসলে? মনে করা যাক ১০০ টা ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ মারতে ৭টা জিম্যাক্স অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন। ২টা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পর দেখা গেল ৬০টা ব্যাকটেরিয়া মারা গেল। শরীর মোটামোটি সুস্থ হতে থাকলো। কিন্তু এই যে বাকি ৪০টা ব্যাকটেরিয়া রয়ে গেল তারা কী করবে? তারা এই জিম্যাক্সকে চিনে ফেললো, এবং নিজেদের আপগ্রেড করে যাতে করে জিম্যাক্স অ্যান্টিবায়োটিকটি তাদের পরবর্তীতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। পরবর্তীতে এই আপগ্রেডেড ব্যাকটেরিয়া আবার যখন আক্রমণ করে, তখন ঐ জিম্যাক্স অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। একটা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষমতাভেদে এদের জেনারেশন রয়েছে। একটা একটা কাজ না করলে এরচেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য। কিন্তু আমাদের ভুলের কারণে ব্যাকটেরিয়া দিন দিন। নিজেদেরকে আপগ্রেড করে একসময় আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামান্য সর্দি কাশিতেও তখন একজন মানুষ মারা যাবে। কেননা ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য যে অস্ত্র (অ্যান্টিবায়োটিক) আমরা তৈরি করেছি, সে অস্ত্র দিয়ে আমরা আমাদের দুশমন ব্যাকিওটেরিয়াদের সমূলে ধ্বংশ না করে তাদের কিছু সদস্যকে বাঁচতে দিয়েছি। আর সে সদস্যরাই অস্ত্রটির ব্যপারে ধারণা নিয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করার মত ব্যবস্থা নিয়ে তাকে রেজিস্ট্রেন্ট করে (প্রতিরোধ) করে ফেলে। অর্থাৎ আমাদের অস্ত্র দিয়ে আমাদেরই ঘায়েল করার টেকনিক ব্যকটেরিয়ারা শিখে যায়। একটা সময় দেখা যেতে পারে ব্যাকটেরিয়ারা সবগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্টেন্ট বের করে ফেলেছে। আর এভাবে একসময় পুরো পৃথিবী মানবশূন্য হয়ে ব্যাকটেরিয়ার বিশাল রাজ্যে পরিণত হবে। যেখানে মানুষের আবিষ্কৃত সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক Cannabidiol & ব্যাকটেরিয়াদের বিপক্ষে কিছু করতে পারছেনা। এখন তোমার জন্য প্রশ্ন!! কাকে তুমি বেশি বুদ্ধিমান বলবে? মস্তিষ্ক থেকেও কেবল নিজের ভুলের জন্য ব্যাকটেরিয়াদের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট করে দেওয়া মানুষদের? নাকি মস্তিষ্ক না থাকা সত্ত্বেও মানুষের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে মানুষের অকালমৃত্যুর কারণ হওয়া ব্যাকটেরিয়াদের? এখন চলো জেনে নিই আমাদের কী করা উচিৎ হবে : ১. রেজিস্টারড ডাক্তারের পরামর্শ ব্যাতিত কোনোপ্রকার অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া। ২. অ্যান্টিবায়োটিকের ফুল কোর্স কমপ্লিট করা। অর্থাৎ ৭ দিনের কোনো ডোজ থাকলে নিয়ম মেনে ৭ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন করা। সুস্থ বোধ করলেও সম্পূর্ণ ডোজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন বন্ধ না করা। ৩. সুস্থ বোধ করলেও সম্পূর্ণ ডোজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ বন্ধ না করা। ৪. খাদ্য দ্রব্যে, গবাদিপশু, খামারের মুরগিতে পরিমিত পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা। ৫. অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব শেষ হওয়ার পর গবাদিপশু বা মুরগি খাবারের জন্য সরবরাহ করা। ৬. সবসময় ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন থাকা। যে কোনো প্রকার ইনফেকশন থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্যাচ ২০১৫, রাউবি